মানবাধিকার কী?
মানুষের জীবন, অধিকার, সমতা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সুযোগ সুবিধাগুলিই মানবাধিকার। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। অধিকারগুলি কেউ কখনো কারো কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে না। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করা হয়। সেখাcনে মানুষের মৌলিক মানবাধিকারগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে। এ জন্য ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস হিসাবে পালিত হয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ অনুযায়ী “মানবাধিকার অর্থ- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত কোন ব্যক্তির জীবন, অধিকার, সমতা ও মর্যাদা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আদালত দ্বারা বলবৎযোগ্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলে ঘোষিত মানবাধিকার।”
বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকার
আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত মানবাধিকারের মূলনীতিগুলিকে বাংলাদেশ সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং নাগরিকের মানবাধিকারের সুরক্ষায় বিভিন্ন বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, বিশ্রাম ও চিত্ত বিনোদন এবং সামাজিক নিরাপত্তার মত অর্থনৈতিক ও সামাজিক মানবাধিকারসমূহ এবং নাগরিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সুরক্ষার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কী ও কেন
মানবাধিকার রক্ষা এবং তার উন্নয়নের প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার প্রশাসন, বিচার ও আইন বিভাগের মাধ্যমে জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদানের জন্য জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান গঠন করে। রাষ্ট্র কর্তৃক গঠিত হলেও জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানসমূহ স্বাধীনভাবে কাজ করে। তারা দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এবং যথাযথ পর্যালোচনা শেষে রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান করে। বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সরকারকে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকারকে পরামর্শ প্রদান করে। দেশে দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৬৭ টি রাষ্ট্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রয়েছে।
বাংলাদেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন -২০০৯ দ্বারা ২০১০ সালের ২২ জুন মাসে একজন চেয়ারম্যান, একজন সার্বক্ষণিক সদস্য এবং পাঁচজন অবৈতনিক সদস্য সমন্বয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যাবলী
বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এখতিয়ার যথেষ্ট বিস্তৃত। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিসমূহ বাংলাদেশ যার পক্ষভুক্ত, ইত্যাদি দলিলপত্রে এই এখতিয়ার সংরক্ষিত। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ এর ধারা-১২ অনুযায়ী কমিশনের কার্যাবলী নিম্নরূপ-
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ দায়েরের পদ্ধতি
কে অভিযোগ করতে পারেন?
জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে কোন বয়সের দেশী বা বিদেশী যে কোন ব্যক্তি কমিশনে অভিযোগ করতে পারেন। অর্থাৎ গ্রামের বা শহরের, সমতলের বা পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর ধনী, গরীব, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত যে কেউ কমিশনে অভিযোগ করতে পারেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে অথবা তাঁর পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানও অভিযোগ করতে পারেন। অবস্থা বিবেচনায় কমিশন স্ব-উদ্যোগেও অভিযোগ গ্রহণ করতে পারে।
কী ধরনের অভিযোগ করা যায়?
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে যে অধিকারগুলি সকল নাগরিককে দেওয়া হয়েছে তার লঙ্ঘন হলে বা লঙ্ঘনের আশঙ্কা তৈরি হলে বা স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে বর্ণিত অধিকারসমূহ লঙ্ঘিত হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ করা যায়। কেউ যদি মনে করেন যে, মানুষ হিসাবে রাষ্ট্রের কাছে তাঁর জীবন, সমতা ও মর্যাদার যে অধিকার পাওনা আছে তা ক্ষুণ্ন হয়েছে কিংবা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন বা কোন জনসেবক বা কোন ব্যক্তি কর্তৃক মানবাধিকার (জীবন, অধিকার, সমতা ও মর্যাদা সংক্রান্ত অধিকার) লঙ্ঘন করা হয়েছে বা লঙ্ঘনের প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে বা এই সব অধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে অবহেলা করা হয়েছে তাহলে মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ করা যায়।
কীভাবে অভিযোগ দাখিল করবেন?
কমিশনের নির্ধারিত ফরমে অথবা সাদা কাগজে হাতে লিখে বা টাইপ করে, কমিশনের অফিসে নিজে অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে উপস্থিত হয়ে অথবা ডাক মারফত, ফ্যাক্স অথবা ইমেইলের মাধ্যমে অভিযোগ পাঠানো যায়। অভিযোগের সাথে অন্যান্য কাগজপত্র, ছবি, অডিও, ভিডিও ক্লিপ ইত্যাদি সংযুক্ত করা যেতে পারে।
অনলাইনে অভিযোগ দাখিল করবেন কীভাবে?
অনলাইনে অভিযোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সফটওয়ারের মাধ্যমে অভিযোগ দাখিল করা যায়। অনলাইনে অভিযোগ দাখিল করার জন্য ভিজিট করুনঃ www.complaint.nhrc.org.bd. এরপর পরবর্তী নির্দেশনা অনুসরণ করুন।
অভিযোগ দেওয়ার পর কী হয়?
(১) অভিযোগ গ্রহণ করার পর কমিশনের বাছাই সেল অভিযোগটির আইনগত দিক পরীক্ষা করে দেখবে;
(২) বাছাই সেল যদি দেখে যে আবেদনটি কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে তাহলে অভিযোগকারীর কী করা উচিত সে বিষয়ে পরামর্শসহ পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে অভিযোগকারীর ঠিকানায় লিখিত উত্তর পাঠাবে;
(৩) অভিযোগটি কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে হলে কমিশন অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে;
(৪) তদন্তে যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় প্রকাশ পায় তাহলে কমিশন অভিযোগকারী এবং অভিযুক্তের মধ্যে উদ্ভূত বিরোধটি মধ্যস্থতা ও সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে;
(৫) মধ্যস্থতা সফল না হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা বা অন্য কোন কার্যধারা দায়ের করার জন্য কমিশন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করবে
মনে রাখবেন
(১) অভিযোগ করা বা অভিযোগ সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া, অভিযোগ করার আগে পরামর্শ করা ইত্যাদির জন্য অভিযোগ দায়ের থেকে নিষ্পত্তির কোন পর্যায়েই কোনো আর্থিক লেনদেন/ খরচ করার প্রয়োজন হয় না।
(২) কমিশনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেন তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে নাগরিকের মর্যাদা, সম্মান, সমতা ইত্যাদির অধিকার লঙ্ঘন করতে না পারে তার প্রতি লক্ষ্য রেখে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা।